জানুন ব্রহ্মা স্বরূপ দেব শিল্পী বিশ্বকর্মার জীবন কাহিনী....!

Vishwakarma-vastukala


এসে গেল বছরের সেই সময় যখন ঘুড়িতে ঘুড়িতে ছেয়ে উঠেছে আকাশ। প্রতিবছর এই সময় আসেন বিশ্বকর্মা, আর ছড়িয়ে দিয়ে যান একমুঠো দুর্গাপুজোর গন্ধ, একরাশ ভাললাগা। আমার বিষয় বাস্তু! তাই আমি বাস্তু বিষয়ক আলোচনা করবো এটাই স্বাভাবিক। অথচ এই  আলোচনার মাঝে যদি দেব শিল্পী বিশ্বকর্মা কে নিয়ে আলোচনা না করি,তাহলে ভীষণ অন্যায় হবে। অবশ্যই এই বিশ্ব সংসার ঈশ্বরের স়ংকল্প মাত্রই সৃষ্টি হয়েছে। আর ঈশ্বরের সেই সংকল্প কে সাকার রূপ দিয়েছেন বাস্তুকার দেব শিল্পী বিশ্বকর্মা। আজ আমি দেব শিল্পী বিশ্বকর্মা সম্পর্কিত কিছু অজানা তথ্য তুলে ধরবো, যা হয়তো আপনি আগে শোনেননি।বিশ্বকর্মার জন্ম নিয়ে নানা পুরাণে নানা রকম কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, ব্রহ্মার নাভিদেশ থেকে বিশ্বকর্মার জন্ম। তাই এই ছবিটি দেখলে মনে হয় , দেব শিল্পী বিশ্বকর্মা যেন সৃষ্টি কর্তা প্রজাপতি ব্রহ্মারই অবতার বা একটি রূপ!  আবার মৎস্য পূরাণ ও ভবিষ্য পুরান মতে তাঁর জন্ম অষ্টবসুর মধ্যে যিনি পঞ্চ ভূতের  অন্যতম আকাশের দেবতা দ্যায়ুস ওরফে প্রভাসের ঔরসে দেবগুরু বৃহস্পতির ভগিনী যোগ সিদ্ধা বরবর্ণিনীর  গর্ভে। এখানে উল্লেখ যোগ্য যে, এই সেই প্রভাস, যে ব্রহ্ম ঋষি বশিষ্ঠের অভিশাপে মাতা গঙ্গার পূত্র রূপে দেবব্রত হয়ে ধরণীতে জন্ম গ্রহণ করে পিতামহ ভীষ্ম নামে মহাভারতে অভিহিত হয়েছিলেন।    বিশ্বকর্মা বৈদিক দেবতা, ঋগবেদের দশম মণ্ডলে ৮১ এবং ৮২ সূক্তদ্বয়ে বিশ্বকর্মার উল্লেখ আছে। ঋগবেদ অনুসারে তিনি সর্বদর্শী এবং সর্বজ্ঞ। তাঁর চক্ষু, মুখমণ্ডল, বাহু ও পদ সব দিকে পরিব্যাপ্ত। তিনি বাচস্পতি, মনোজব, বদান্য, কল্যাণকর্মা ও বিধাতা অভিধায় ভূষিত। তিনি ধাতা, বিশ্বদ্রষ্টা ও প্রজাপতি।




বিশ্বকর্মা পূজার ধ্যানমন্ত্র:


দংশপালঃ মহাবীরঃ সুচিত্রঃ কর্মকারকঃ। বিশ্বকৃৎ বিশ্বধৃকতঞ্চ বাসনামানো দণ্ডধৃক।। ওঁ বিশ্বকর্মণে নম:

বেদ ও পুরাণ অনুযায়ী বিশ্বকর্মার ভিন্ন রূপ।স্কন্দপুরাণ মতে আবার, বিশ্বকর্মার পাঁচটি মুখ ও দশটি হাত। বিশ্বকর্মা ব্রহ্মাস্বরূপ। তাঁর পাঁচটি মুখ। প্রতিটি মুখের নাম ভিন্ন ভিন্ন। যেমন সদ্যোজাত, বামদেব, অঘোর, তৎপুরুষ এবং ঈশান। তাঁর দশটি হাত। তাঁর বাহন হংস। সুতরাং একদিকে তিনি ‘বিশ্বতোমুখ’ এবং জ্ঞানস্বরূপ। হংস সেই জ্ঞানকেই প্রকাশ করছে। এখানেই ব্রহ্মা আর বিশ্বকর্মা একাত্ম হয়ে যান। বিশ্বকর্মার পত্নী দৈত্যরাজ ভক্ত প্রহ্লাদের কন্যা বিরোচনা। কন্যা দেবী সঙ্গা বা সঞ্জনার বিবাহ হয় সূর্য্য দেবের সঙ্গে। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা হলেন ‘দেবানাং কার্য্যসাধকঃ’, অর্থাৎ দেবতার সকল কর্মের সাধক ঩তিনিই। এখানে কর্ম মানে শিল্প বা সৃষ্টিকে বোঝানো হয়েছে। একই সঙ্গে বোঝানো হয়েছে, তাঁকে ব্যতীত দেবতাদের কোনও কর্ম সম্পন্ন হওয়া সম্ভব নয়। তিনি শিল্পের দেবতা। তিনি কর্মের দেবতা। দেবলোকে বা মর্ত্যলোকে তিনি বহু কিছু নির্মাণ করেছেন। মূলত বিশ্বকর্মা ছাড়া দেবতাদের কোনও শক্তির কথা ভাবাই যায় না। কিংবা তাঁদের বিলাসের কথাও ভাবা যায় না। 





বেদে এই বিশ্বকর্মাকে অজাত পুরুষ বা সনাতন পুরুষ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। বিশ্বকর্মা নানান শিল্প রচনা করেন। যেমন রামায়ণে উল্লেখিত কুঞ্জর পর্বতে ঋষি অগস্ত্যর  ভবন, পুষ্পক বিমান,   কৈলাসে কুবেরের অলকা পুরী, স্বর্গের দেব সভা অমরাবতী, রাবনের স্বর্ণ লঙ্কা, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা পুরী,ভক্ত রাজ সুদামার বাসস্থান  সুদামা পুরী এবং হস্তিনাপুর ও ইন্দ্রপ্রস্থ। তবে ইন্দ্রপ্রস্থের নির্মাণ করেন দেব শিল্পী বিশ্বকর্মার সঙ্গে যৌথভাবে দৈত্য শিল্পী ময় দানব। আবার কলিতে কামাখ্যা মন্দির ও পুরী ধামে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার মূর্তির রূপকার  বিশ্বকর্মা স্বয়ং। দেবতাদের সকল প্রকার অস্ত্র, যেমন দেবরাজ ইন্দ্রের বজ্র, ভগবান শিবের ধনুক পিনাকি, ত্রিশূল- সব এঁনার সৃষ্টি। এছাড়াও মার্কণ্ড পুরানে দেখতে পাই ইনি দেবীকে অভেদ্য কবচ, পরশু ও নানান অস্ত্র প্রদান করেছিলেন। বিশ্বকর্মার হস্তে দাঁড়িপাল্লা থাকে। দাঁড়িপাল্লার দুটি পাল্লা জ্ঞান ও কর্মের প্রতীক। উভয়ের সমতা বজায় রেখেছেন তিনি। এছাড়া তিনি হাতুরী ধারন করেন- যা শিল্পের সাথে জড়িত। তিনি যে শিল্পের দেবতা।           ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির দিন বিশ্বকর্মার পূজা করা হয়। বিভিন্ন কলকারখানায় বেশ আড়ম্বরের সঙ্গে বিশ্বকর্মার পূজা অনুষ্ঠিত হয়। অন্যান্য দেব-দেবীর মতোই মূর্তি গড়ে অথবা ঘটে-পটে বিশ্বকর্মার পূজা করা হয়। সূতার-মিস্ত্রিদের মধ্যে এঁর পূজার প্রচলন সর্বাধিক। তবে বাংলাদেশে স্বর্ণকার, কর্মকার এবং দারুশিল্প, স্থাপত্যশিল্প, মৃৎশিল্প প্রভৃতি শিল্পকর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিগণও নিজ নিজ কর্মে দক্ষতা অর্জনের জন্য বিশ্বকর্মার পূজা করে থাকেন। এ সময় প্রত্যেকের ঘরে বিশেষ খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হয় এবং কোথাও কোথাও পূজার পরে ঘুড়ি ওড়ানো হয়। 


বিশ্বকর্মা যে শুধু কর্মে সুদক্ষ তা নয়, তিনি বেশ কিছু গ্রন্থও লিখে রেখে গেছেন তার উত্তরসূরীদের জন্য। এবার আলোচনা করব বিশ্বকর্মার লেখক-প্রতিভা এবং লেখালেখি বিষয়ে।


Vishwakarma_vastu_shastram

বিশ্বকর্মার রচিত স্থাপত্যশিল্প বিষয়ক গ্রন্থটির নাম "বাস্তুশাস্ত্রম"। "মানসার" এবং "ময়মতম" গ্রন্থে বস্তু ও বাস্তু শব্দদুটিকে সমার্থক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। 'বস্তু' শব্দ থেকে 'বাস্তু' কথাটা এসেছে। 'বাস্তু' শব্দের অর্থ পৃথিবী। ব্যাপক অর্থে সমস্ত প্রাণীর আবাসস্থলই বাস্তু। অর্থাৎ, স্রষ্টার যে-কোনো সৃষ্টিই বাস্তু। কাজেই শুধু পরিকল্পিত মনুষ্যগৃহই নয়, দেবতা থেকে শুরু করে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর আবাসকেই বাস্তু বলে। বাস্তুশাস্ত্রে বাস্তু শব্দের অর্থ ব্যাপক। এই শিল্পকে নির্মাণ শিল্পকে না-বুঝিয়ে পরিকল্পনা, নির্মাণ, চিত্র, অলংকরণ, স্বর্ণ-চর্ম-বয়নশিল্প, অস্ত্রশিল্প, পোতনির্মাণ, মূর্তিনির্মাণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত আছে।



পুরাণে উল্লেখ আছে, চারটি বেদের মতো চারটি উপবেদও আছে। উপবেদগুলি হল আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গান্ধর্ববেদ এবং স্থাপত্যবেদ। এই উপবেদ স্থাপত্যবিদ্যা বা বাস্তুবিদ্যার রচয়িতা হলেন বিশ্বকর্মা। বলা হয় তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রধান বাস্তুকার।


অন্যদিকে মৎস্যপুরাণের ২৪২ থেকে ২৪৭ অধ্যায়, অগ্নিপুরাণের ১০৪ থেকে ১০৬ অধ্যায়, গরুড়পুরাণের ৪৬ থেকে ৪৭ অধ্যায়, ভবিষ্যপুরাণ, বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণের তৃতীয় খণ্ড, বিভিন্ন আগম, শুক্রনীতিসারের চতুর্থ অধ্যায়, বৃহসংহিতা, গৃহ্যসূত্র, খ্য প্রভৃতিতে বাস্তুশাস্ত্রের আলোচনা পাওয়া যায়। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় গণপতিশাস্ত্রী বাস্তুবিদ্যা বা বাস্তুশাস্ত্রম গ্রন্থটি আবিষ্কার করে মুদ্রিত করেন। বিশ্বকর্মার নামে প্রচলিত বাস্তুশাস্ত্রটির নাম "বিশ্বকর্মাবাস্তুশাস্ত্রম"।


আর্যাবর্তের শিল্পধারা বিশ্বকর্মার দ্বারা প্রবর্তিত বলে মনে করা হয়। বিশ্বকর্মার "বাস্তুশাস্ত্রম"-এর প্রথমেই বলা হয়েছে, জগতের কল্যাণ কামনায় এই শাস্ত্র প্রচার করছেন - "বাস্তুশাস্ত্রং প্রবক্ষ্যামি লোকানাং হিতকাম্যয়া"। বিশ্বকর্মার নামে এরকম গ্রন্থ অন্ততপক্ষে দশটি পাওয়া গেছে।


Lord_Vishwakarma_vastu_shastram





                     

ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরান মতে বিশ্বকর্মা ও স্বর্গের দেব নর্তকী ঘৃতাচী, দুজনেই শাপ গ্রস্থ হয়ে ধরাধামে জন্ম নেন। তাঁদের নয়টি সন্তান হয় – যথা মালাকার , কর্মকার , কাংস্যকার, শঙ্খকার , সূত্রধর, কুবিন্দক, কুম্ভকার, স্বর্ণকার, ও চিত্রকর । বিশ্বকর্মা প্রত্যেক কেই নানান শিল্প শেখান । তিনি মালাকারকে পুস্প শিল্প, কর্মকারকে লৌহ শিল্প, কাংস্যকারকে কাংস শিল্প, শঙ্খ কারকে শঙ্খ শিল্প, সূত্রধরকে কাষ্ঠ শিল্প, কুবিন্দক কে বয়ন শিল্প, কুম্ভকারকে মৃৎ শিল্প, স্বর্ণকারকে অলঙ্কার শিল্প, চিত্রকরকে অঙ্কন শিল্প শেখান। ।আমরা কিন্তু যে বিশ্বকর্মার পুজো করি, তাঁর অন্যরূপ। তাঁর একটি মুখ, চারটি হাত, হাতি তাঁর বাহন। তাঁর রূপ অনেকটা কার্তিকের মতো। স্বামী নির্মলানন্দের বই থেকে জানা যায়, বিশ্বকর্মার এই রূপ প্রবর্তন করেছিলেন কর্মকার সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট নেতা স্বর্গত হরষিত কেশরী রায়। আমাদের দেশের হস্তশিল্পীরা মূলত এই রূপের পুজো করেন। তাঁর হাতে হাতুড়ি, ছেনি, আবার কখনও মানদণ্ড। এগুলি একদিকে যেমন নির্মাণের প্রতীক, তেমনই আবার শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে পরিমাপের হিসাবটিকেও মুখ্য হিসাবে প্রকাশ করা হয়েছে।  শতপথ ব্রাহ্মণ থেকে জানা যায়, বিশ্বকর্মা মাঝেমাঝেই সর্বমেধ যজ্ঞ করেন। সেই যজ্ঞে তিনি বিশ্বের সবকিছুকে আহুতি দেন। সমস্ত জীবকূলকেও তিনি আহুতি দেন। সবশেষে সেই যজ্ঞে তিনি নিজেকেও আহুতি দেন। এভাবেই বিশ্ব একসময় লয়প্রাপ্ত হয়। আর সেই যজ্ঞের আগুন থেকেই জেগে ওঠেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। আবার তিনি নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় মেতে ওঠেন। জেগে ওঠে নতুন প্রাণ, নতুন জগৎ। এভাবেই ধ্বংসের পরে সৃষ্টি আর সৃষ্টির পরে ধ্বংস আসে। আর বিশ্বকর্মা আমগ্ন থাকেন সৃষ্টির বিরচনে। কাল, যুগ, পর্ব সব এভাবেই তাঁর হাত ধরেই এগিয়ে চলে। মহাকালের এ এক অনিবার্য খেলা।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ভোজ্য পত্র কি ? আসল ও নকল ভোজ্য পত্র চিনবেন কিভাবে ?

বারো মুখী রুদ্রাক্ষের উপকারিতা ও ব্যবহার বিধি !

স্বপ্ন দোষ ? কালসর্প দোষ ? বশীকরণ বা কর্মে সাফল্য চান? তাহলে জানুন ময়ুর পালকের কিছু অসামান্য গুনাগুন!