এই মন্দিরের ইতিহাস বলতে গেলে ফিরে যেতে হবে বেশ অনেকটা লম্বা ফ্লাশ ব্যাকে । কয়েক শতাব্দী পেছনে। সময় টা ১১৯২ খ্রীস্টাব্দ। দিল্লির মসনদে তখন মহম্মদ ঘোরী। তৎকালীন ভূরশুট পরগনার অধিপতি ছিলেন শনিভাঙ্গর। তাকে পরাজিত করে রাজা হন চতুরানন, আনুমানিক তিনি প্রায় ৪০ বছর রাজত্ব করেন। পরে নিজের জামাতাকে সিংহাসনে অভিষিক্ত করেন। তিনি হলেন রাজা সদানন্দ। যিনি ১০ বছর রাজত্ব করেন দামোদর ও রননদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল রাজবল হাট গ্রামে।
প্রাচীন বাংলার রাঢ় অঞ্চলের দক্ষিণাংশে একটি উল্লেখযোগ্য হিন্দু রাজ্য ছিল ভূরিশ্রেষ্ঠ বা ভুরশুট পরগনা। হুগলি এবং হাওড়া জেলার কিছু অঞ্চল নিয়ে এই রাজ্য গঠিত হয়েছিল। ধনী বণিক সম্প্রদায় ভূরিশ্রেষ্ঠদের বাস ছিল এই অঞ্চলে, এবং এই কারণেই এই স্থানের ভূরিশ্রেষ্ঠ নাম। পঞ্চদশ শতকেও এই রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়। রাজবলহাট ছিল এই ঐতিহাসিক রাজ্যের রাজধানী। এই ছোট্ট, শান্ত জনপদে অতীতের সেই গৌরব আজ আর নেই। কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে সম্পূর্ণ রাজবংশ ও রাজপ্রাসাদ। টিকে আছে শুধুমাত্র রাজবল্লভী মায়ের মন্দির, এছাড়াও এখানে আছে আরো কয়েকটি টেরাকোটার কাজ সম্বলিত মন্দির।
বুদ্ধদেবের মহানির্বাণের পর ছ' টি শতাব্দী পার হতে না হতেই সম্রাট কণিষ্কের রাজ সভায় আনুষ্ঠানিক ভাবে বৌদ্ধ ধর্ম দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। মহাযান ও হীনযান। প্রসঙ্গত প্রথম থেকেই ভারত বর্ষে মহাযান সম্প্রদায়ের প্রভাব বেশি ছিল। এই বাংলাতেও বেশ কিছু যায়গায় তার নিদর্শন চোখে পড়ে। , এই অঞ্চলেও ছিল একটি বৌদ্ধ মন্দির! যেখানে অধিষ্ঠাত্রী দেবী ছিলেন, এক মহাযান দেবী মূর্তি। বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া এই প্রাচীন রাজধানীটি আজও মনে বিস্ময়ের উদ্রেক করে।
সূর্য্য অস্তগামী দামোদরের তীরে, এমন সময় ক্লান্ত রাজা সদানন্দ একদিন তার শিকার করা পশুদের সামনে বিষন্ন চিত্তে দাঁড়িয়ে আছেন। ভাবছেন যে, তিনি এতই নরাধম, যে ব্রাহ্মণ কুলে জন্মগ্রহণ করেও নিজেকে শুধু শুধু রাজ রক্ষায় বন্দী করে রেখেছেন। এমন সময় হঠাৎ দেখলেন, কিছু দুরে রুদ্রাক্ষ মালা পরিহিত এক ব্রাহ্মণ ঋষি ধ্যান মগ্ন অবস্থায় পদ্মাসনে বসে আছেন। রাজা কাছে গিয়ে তাকে প্রণাম করলেন। রাজা সেই ব্রাহ্মণ ঋষি কে তার মনের দ্বন্দ্বের কথা জানালেন। ঋষি তখন তাকে আস্বস্ত করে শক্তি মন্ত্রে দীক্ষিত করেন। তার পথনির্দেশ মতো রাজা শিব সাধনায় ব্রতী হয়ে সিদ্ধি লাভ করেন। ওই সাধনাকালেই ভগবতী মহামায়া দ্বিভূজা ষোড়শী রমণী মূর্তি রূপে দেখা দেন। এবং আদেশ করেন যেন এই জায়গাতেই তার মূর্তি স্থাপন করে পূজার ব্যবস্থা করা হয় । এরপরেই সাধক সদানন্দ বরাভয়দায়িনী, ত্রিনয়নী, নৃমুন্ডমালিনী, শ্বেত কালিকা দেবী রাজবল্লভী মায়ের প্রতিষ্ঠা করেন।
ষোড়শ শতাব্দীতে রাজা রুদ্রনারায়ণ দ্বারা বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয় এবং ১৩৪০ বঙ্গাব্দে স্থানীয় কিছু ব্যক্তিদের অর্থানুকুল্যে মন্দিরটির আমূল সংস্কার করা হয়।
মূল মন্দিরের ফটকের ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে একটি নাট মন্দির। ১৩৪৬ বঙ্গাব্দে মন্দিরের সামনে এই নাট মন্দিরটি নির্মান করা হয়।
বাম দিক থেকে শ্রী ত্র্যম্বকেশ্বর, শ্রী সোমেশ্বর,প্রতি ১২ থেকে ১৪ বছর অন্তর দেবীর নব কলেবর হয়। তখন গঙ্গাজল আর গঙ্গা মাটি দিয়ে পুনরায় নতুন বিগ্রহ তৈরি করা হয়। সেই দেবী মূর্তি কে বৈশাখ মাসের শুভ অক্ষয় তৃতীয়ার দিন ভোরবেলায় প্রতিষ্ঠা করা হয়। যে কারণে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন ভোরবেলায় মায়ের বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয়। প্রতিদিন মন্দিরের দ্বার খোলা হয় সকাল সাতটায়। পূজা আরম্ভ হয় ঠিক সকাল এগারোটায়। দুপুর দেড়টায় হয় মায়ের অন্ন ভোগ নিবেদন। দুপুরে মায়ের ভোগে নিবেদন করা হয়, ভাত, ডাল, ঘ্যাঁট ( পাঁচ মিশালি সবজি দিয়ে তরকারি ) , তেঁতুল দিয়ে মাছের অম্বল বা টক ( শোনা যায় এই পদটি নাকি মায়ের ভীষণ প্রিয় ), এবং পায়েস। এরপর সন্ধ্যারতি হয় সন্ধ্যা সাতটায়। আরতি শেষে মাকে নিবেদন করা হয়, লুচি, সন্দেশ, ও ছানা। সবশেষে মাকে তামাক সেঁজে দিয়ে দোর বন্ধ করে দেওয়া হয়।
শরৎ কালে দুর্গাপুজোর সময়ে এখানে মহাসমারোহে দুর্গোৎসব পালন করা হয়ে থাকে। এখানকার প্রধান উৎসব দুর্গাপূজার সময়ে হয়ে থাকে। দুর্গাপুজো সু-সম্পূর্ণ হয় মঙ্গল ঘটে। অষ্টমী তিথিতে বিশেষ জল ঘড়ির সময় অনুযায়ী সন্ধি পূজার সময় নির্ধারণ করা হয়। এখানকার পূজা শুরু হওয়ার পরই এই অঞ্চলের অন্যান্য দূর্গাপূজা শুরু হয়। নবমীর দিন হয় ছাগ বলি, এছাড়া পুরানো রীতি মেনে এখানে হয় মহিষ বলি। ওই দিন মায়ের অন্ন ভোগ হয় না, মাকে শুধু ছাতু ভোগ নিবেদন করা হয়। এছাড়াও চৈত্র সংক্রান্তির দিন অন্ন ভোগের পরিবর্তে হয় চিড়ে ভোগ। এই দুই দিন ব্যতীত সারা বছর মাকে অন্ন ভোগ নিবেদন করা হয়। এবং সেই প্রসাদ উপস্থিত সকল ভক্ত দের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হয়। প্রসাদের জন্য সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে কুপন সংগ্রহ করতে হবে। কুপনের মূল্য ২৫ টাকা। তবে সর্বাধিক ৭০০ জনের প্রসাদ গ্রহণের ব্যবস্থা আছে।
মন্দির সংলগ্ন দীঘির ঘাটরাজবল্লভী মায়ের মন্দির পরিচালনার জন্য একটি কমিটি রয়েছে। কিন্তু মা তার সারা বছরের পূজার যাবতীয় খরচ চালানোর ব্যবস্থা নিজেই করে রেখেছেন। মায়ের নামে একটি বড় দীঘি ও বেশ কয়েকটি পুকুর রয়েছে। আছে বেশ কয়েক বিঘা জমি। আর মায়ের নামাঙ্কিত জমিতে কিছু দোকান ঘর ভাড়া দেওয়া আছে। এই সমস্ত কিছু থেকে যা আয় হয় তা দিয়েই মায়ের সেবা হয়। এছাড়াও অগণিত ভক্তের সক্রিয় সহযোগিতা তো আছেই। বিশেষ করে এখানে উল্লেখ করতে হয় স্থানীয় গ্রামবাসি দের কথা। এখানে একটা রীতি প্রচলিত আছে যে, যার বাড়িতে বা জমিতে প্রথম যে ফসল উৎপাদন হয়, সেটা রাজবল্লভী মায়ের নামে উৎসর্গকৃত করা হয়। এমনকি নিজের পুকুরের মাছ পর্যন্ত।
পূজোর ভাগ বছরে কয়েকটি পালা করে চলে। যার যখন পালা আসে , তখন তিনি তার সব ব্যবস্থা করে থাকেন। ওই যে বললাম, ভোগের জন্য জন প্রতি মাথা পিছু যে, ২৫ টাকা করে নেওয়া হয়, তার মধ্যে থেকে ১ টাকা করে সরাসরি যায় মা রাজবল্লভীর এস্টেটে। শনি, রবি ও ছুটির দিন গুলো তো জনসমাগম বেশ ভালোই হয়।
# মন্দির খোলার সময় : সকাল ৭টা থেকে রাত্রি ১০টা । শীতের সময় রাত্রি ৮টা অবধি খোলা থাকে।
রাধা কান্ত মন্দির, ঘটক তলা
মায়ের মন্দির দর্শন হয়ে গেলে, যদি হাতে সময় থাকে, তাহলে আশে পাশের এলাকায় পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখে নিতে পারেন। পায়ে হেঁটেই চলে আসুন রাজবলহাট বাজারে। এই পথেই বাজার ছাড়িয়ে আরো কিছুটা হেঁটে গেলে ঘটক তলা, এখানেই দেখতে পাবেন আঠেরোশো শতকে নির্মিত রাধাকান্ত মন্দির। এই মন্দিরের টেরাকোটার কাজ কিন্তু বেশ আকর্ষণীয়। এছাড়াও আর একটি উল্লেখযোগ্য মন্দির হল শ্রীধর দামোদর মন্দির।
শ্রীধর দামোদর মন্দির, শীল বাটী।এখানে একটি অমূল্য প্রত্নশালা নামে একটি সংগ্রহালয় আছে। কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ও বাংলার তালমিছরি শিল্পের জনক দুলাল চন্দ্র ভড়ের বাড়িও এই রাজবলহাট গ্রামে।
# পথনির্দেশ : হাওড়া স্টেশন থেকে তারকেশ্বর, আরামবাগ, বা গোঘাট লোকালে চলে আসুন এক ঘন্টার মধ্যে হরিপাল স্টেশন। সেখান থেকে বাস বা ট্রেকারে চড়ে রাজবলহাট। হাওড়া থেকে সরাসরি বাস যায়। আঁটপুর থেকে রাজবলহাটের দূরত্ব খুব বেশি নয়। এই দুটি জায়গা একই দিনে ঘুরে নেওয়া যায়।
















কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন